★★স্বামীর নিকট স্ত্রীর কি কি হক।★★
ইসলাম মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর মনোনীত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। একজন স্ত্রী যেমন স্বামী ছাড়া পরিপূর্ণ নয় তেমনি একজন স্বামীও স্ত্রী ছাড়া পরিপূর্ণ নয়। সৃষ্টিগতভাবেই মহান আল্লাহ এই সম্পর্কটাকে একে অপরের সহায়ক এবং পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন ।
নবী কারীম (সা.) বলেছেন, ‘নারীরা পুরুষের অর্ধাংশ’। (আবু দাউদ, তিরমিযী) শুধু হজরত আদম (আ.) দ্বারা এই পৃথিবী কখনোই পরিপূর্ণতা লাভ করত না আর তাই হাওয়ার (আ.) এর আগমন ঘটিয়েছিলেন মহান আল্লাহ পাক। একজন স্ত্রীর নিকটে স্বামীর যেমন কিছু হক বা অধিকার রয়েছে, তেমনি একজন স্বামীর নিকটেও স্ত্রীর কিছু হক বা অধিকার রয়েছে । মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেন, ‘পুরুষগণ নারীদের প্রতি দায়িত্বশীল, যেহেতু আল্লাহ একের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ হতে ব্যয়ও করে।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ৩৪)

সূরা নিসার যে আয়াতটি বিবাহের খোতবায় তেলাওয়াত করা হয়, সে আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, দেখ! তুমি ও তোমার স্ত্রীর মাঝে জন্মগতভাবে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহ্পাক হাওয়া (আ.)- কে হজরত আদম (আ.) এর বুকের বাম পাশের হাড় থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাই বলা হয় নারী পুরুষেরই অংশ। তোমার শরীরের যেকোনো স্থানে আঘাত লাগলে তুমি কষ্ট পাও। আঘাত যেন না লাগে, সে ব্যবস্থা কর। সে কারণে তোমার স্ত্রীর প্রতিও লক্ষ রাখবে, সে-ও তোমার শরীরের একটি অংশ। ইজাব কবুলের মাধ্যমে সে তোমার কাছে এসেছে, তুমি তোমার শরীরের সঙ্গে যেমন ব্যবহার কর, স্ত্রীর সঙ্গেও সেরূপ ব্যবহার কর। তুমি স্ত্রীর কাছ থেকে যেমন মহব্বতপূর্ণ মুলায়েম ও ভক্তিপূর্ণ কথা আশা কর, স্ত্রীর সঙ্গে তুমিও এমন কথা বল যেন তোমার কথা থেকে মহব্বত ও ভালোবাসা ঝরে পড়ে।

মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। আর যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবুও তুমি যা অপছন্দ করছ হয়তো আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবেন।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ১৯)

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ মুমিন নারীর ওপর রাগান্বিত হবে না। কেননা যদি তার কোনো কাজ খারাপ মনে হয়, তাহলে তার এমন গুণও থাকবে, যার জন্য সে তার ওপর সন্তুষ্ট হতে পারবে’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৬৯)
অন্য আরেক হাদিসে এসেছে যে, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ভালো মানুষ তারাই, যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১১৬২)

রাসূলুল্লাহ (সা.) পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, ‘তুমি যখন খাবে, তাকেও খাওয়াবে এবং তুমি যখন পরিধান করবে, তাকেও পরাবে। তার চেহারায় কখনো প্রহার করবে না। তার সঙ্গে অসদাচরণ করবে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ২১৪২; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৮৫০১)

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য: সুখকর দাম্পত্য জীবন, সুশৃঙ্খল পরিবার, পরার্থপরতায় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থে ইসলাম জীবন সঙ্গী স্বামীর ওপর কতিপয় অধিকার আরোপ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এখানে প্রদত্ত হলো।

(১) দেনমোহর পরিশোধ: নারীর দেনমোহর পরিশোধ করা ফরজ। এ হক তার নিজের, পিতা-মাতা কিংবা অন্য কারো নয়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেন, ‘তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে স্ত্রীদের মোহরানা দিয়ে দাও।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ৪)

(২) বাসস্থান: নিরাপদ বাসস্থান বা নিরাপদ আবাসন। অর্থাৎ, স্বামী-স্ত্রীকে থাকার জন্য এমন একটি ঘর বা কক্ষ দেবেন, যে ঘর বা কক্ষে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া (স্বামী ব্যতীত) কেউই প্রবেশ করতে পারবেন না। এমনকি স্বামীর মা-বাবা, ভাই-বোনও না। স্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে এই ঘরে বা কক্ষে তিনি তালাচাবিও ব্যবহার করতে পারেন। স্ত্রীর ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বিষয়ে স্বামী ছাড়া কেউই নাক গলাতে পারবেন না। স্ত্রীর স্যুটকেট, ট্রাঙ্ক ও আলমারি স্বামী ছাড়া কেউ তল্লাশি করতে পারবেন না। কোনো স্ত্রীর চলাফেরা বা আচার-আচরণ শ্বশুর-শাশুড়ির অপছন্দ হলে তাকে আলাদা বাড়ি বা ঘর করে দেওয়া উচিত। স্ত্রীর ব্যবহৃত কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও স্বামীকেই করতে হবে এবং স্ত্রীর ফুত ফরমাশ ধরার জন্য একজন কাজের লোকও রাখবেন স্বামী। (শরহে বেকায়া, কিতাবুন নিকাহ)

(৩) স্ত্রীর ভরন পোষণ: সামর্থ্য ও প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্ত্রীর ভরন-পোষণ করা স্বামীর কর্তব্য। স্বামীর সাধ্য ও স্ত্রীর চাহিদার ভিত্তিতে এ ভরন-পোষণ কম বেশি হতে পারে। অনুরূপ ভাবে সময় ও স্থান ভেদে এর মাঝে তারতম্য হতে পারে।মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেন, ‘বিত্তশালী স্বীয় বিত্তানুযায়ী ব্যয় করবে। আর যে সীমিত সম্পদের মালিক সে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত সম্পদ হতেই ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ দিয়েছেন, তারচেয়ে’ বেশি ব্যয় করার আদেশ কাউকে প্রদান করেন না।’ (সূরা: তালাক, আয়াত: ৭)

(৪) স্ত্রীর প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু থাকা: স্ত্রীর প্রতি রূঢ় আচরণ না করা। তার সহনীয় ভুল সমূহকে ক্ষমা করে ধৈর্যধারণ করা। স্বামী হিসেবে সকলের জানা উচিত, নারীরা মর্যাদার সম্ভাব্য সবকটি আসনে অধিষ্ঠিত হলেও, পরিপূর্ণ রূপে সংশোধিত হওয়া সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও। কারণ, তারা পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্ট। পাঁজরের ওপরের হাড়টি সবচেয়ে বেশি বাঁকা।’ (যে হাড় দিয়ে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে) তুমি একে সোজা করতে চাইলে, ভেঙে ফেলবে। আবার এ অবস্থায় রেখে দিলে, বাঁকা হয়েই থাকবে। তাই তোমরা তাদের কল্যাণকামী হও, এবং তাদের ব্যাপারে সৎ-উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সহীহ বুখারি)

(৫) স্ত্রীর প্রতি যত্নশীল ও সতর্ক হওয়া: হাতে ধরে ধরে তাদেরকে হেফাজত ও সুপথে পরিচালিত করা। কারণ, তারা সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল, স্বামীর যেকোনো উদাসীনতায় নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ কারণে রাসূল (সা.) নারীর ফেতনা হতে খুব যত্ন সহকারে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার অবর্তমানে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর কোনো ফেতনা রেখে আসিনি।’ (সহীহ বুখারী,হাদীস নং: ৪৭০৬)

(৬) স্ত্রীর প্রতি আত্মমর্যাদাশীল হওয়া: স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আত্মম্ভরিতার প্রতি লক্ষ্য করে রাসূল (সা.) বলেছেন যে, ‘তোমরা সা’আদ এর আবেগ ও আত্মসম্মানবোধ দেখে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো । আমি তার চেয়ে বেশি আত্মসম্মানবোধ করি, আবার আল্লাহ আমার চেয়ে বেশি অহমিকা সম্পন্ন।’ (সহীহ মুসলিম,হাদীস নং: ২৭৫৫) শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, যার মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ নেই সে দাইয়ূছ (অসতী নারীর স্বামী, যে নিজ স্ত্রীর অপকর্ম সহ্য করে)। হাদিসে এসেছে: ‘দাইয়ূছ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (দারামি: ৩৩৯৭)

উক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও একজন স্বামীর ওপর স্ত্রীর আরো কিছু হক বা অধিকার রয়েছে যেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

১. সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণ-পোষণ ও খরচাদি দিতে কোনো প্রকার অবহেলা না করা,

২. স্ত্রীকে দ্বীনি মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা প্রদান করা,

৩. ভালো কাজের প্রতি উদ্ভূত করা,

৪. যাদের সঙ্গে দেখা দেয়ার ব্যাপারে ইসলামের অনুমতি রয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ প্রদান করা,

৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ প্রদান করা,

৬. কোনো প্রকার ভুল বা অসাবধানতা হলে ধৈর্য ধারণ করা,

৭. শাসন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা,

৮. মহর আদায় করা,

৯. ইসলামি শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে স্ত্রীর মন জয় করা,

১০. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে সমতা বজায় রাখা,

১১. নির্যাতন না করা, ইত্যাদি ।

পরিশেষে বলা যায় যে, স্ত্রী হলেন সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানের জননী; তাই স্ত্রী সম্মানের পাত্রী। স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার; সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে এবং উভয়ের পরিবার প্রত্যেকে নিজ নিজ অধিকারের সীমানা ও কর্তব্যের পরিধি জেনে তা চর্চা করে তাহলে তা সংসারের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে রাসুল (সাঃ)-এর জন্ম তারিখ উপলক্ষে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সরকারী ছুটিও ঘোষণা করা হয়ে থাকে। আবার একে কেউ কেউ ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ’ বলে থাকেন।
প্রচলিত মিলাদুন্নবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
প্রথম যুগে সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মদিন পালন করার কোনো প্রচলন ছিলনা। যদি থাকতো তাহলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঠিক জন্মতারিখ নিয়ে মতবিরোধের কোনো সুযোগ থাকতো না। আসলে ইসলামে জন্মদিবস পালন করার কোনো বিধানই নেই। এজন্যই তৎকালীন সময়ে কেউ জন্মদিন পালন করতো না।
পরবর্তী যুগে অর্থাৎ রাসুল (সাঃ)-এর মৃত্যুর কয়েকশত বছর পরে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের মাধ্যমে, খানাপিনার আয়োজন করে, দান-সদকা করে, আনদ উৎসব করে এই ১২ই রবিউল আউয়ালকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কল্পিত জন্মদিন হিসাবে পালন করার রেওয়াজ শুরু হয়।
শি’আরা সর্বপ্রথম মিলাদুন্নবী আবিস্কার করেঃ
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মিশরের ফেরাউন জন্মোৎসব পালন করতো। ফেরাউন ছিল ইয়াহুদী। পরবর্তীতে এই রীতি খ্রিষ্টানদের মধ্যেও চলে আসে। যার ফলে তারা ২৫শে ডিসেম্বর ঈসা (আঃ)-এর জন্মদিন বা ‘ক্রিসমাস ডে’ পালন করে। যদিও এই তারিখের নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমান নেই।
অতঃপর ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের এই জন্মদিবস পালনের রেওয়াজ শরীয়তের জ্ঞান বিবর্জিত কিছু মানুষদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সর্বপ্রথম মুসলিম নামধারী শি’আরা এই জঘন্য প্রথা চালু করে। কালক্রমে তা সুন্নীদের মাঝে বিস্তার লাভ করে।
৩৫৮ হিজরী (৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে ৫৬৭ হিজরী (১১৭২ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত রাফেযী ইসমাইলী শি’আগন মিশর শাসন করে। এই দুই শতাব্দীর মধ্যে শি’আ শাসকগণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দু’ই ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) ছাড়াও আরও বিভিন্ন দিবস পালন করতো, তন্মধ্যে অধিকাংশই ছিল জন্মদিন। তারা অত্যন্ত আনন্দ উৎসবের সাথে ৭টি জন্মদিন পালন করতো।
১) রাসুল (সাঃ)-এর জন্মদিন।
২) আলী (রাঃ)-এর জন্মদিন।
৩) ফাতেমা (রাঃ)-এর জন্মদিন।
৪) হাসান (রাঃ)-এর জন্মদিন।
৫) হুসাইন (রাঃ)-এর জন্মদিন।
৬) তাদের জীবিত খলীফার জন্মদিন।
৭) ঈসা (আঃ)-এর জন্মদিন।
আল-মাকরীযী, আহমাদ ইবন আলী, আল-মাওয়ায়িজ ওয়াল ইতিবার বিন যিকরিল খুতাতি ওয়াল আসার; পৃষ্ঠা নঃ ৪৯০-৪৯৫
আহমদ ইবন আলী আল-কালকাশান্দী (৮২১ হিজরী) বলেন, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে ফাতেমী শাসক মীলাদুন্নবী উদযাপন করতেন। তারা এই উপলক্ষে বিপুল পরিমান মিষ্টান্ন দ্রব্য করতেন। এই মিষ্টান্ন ৩০০ পিতলের খাঞ্চায় ভরা হতো। মীলাদের রাত্রিতে এই মিষ্টান্ন বিতরন করা হতো। তৎকালীন শাসক প্রাসাদের সামনে ব্যালকনিতে বসতেন। আসর নামাযের পর বিচারপতি ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আজহার মসজিদে প্রবেশ করে কুরআন তিলাওয়াত ও বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। এভাবে তারা আলী (রাঃ)-এর জন্মদিনও পালন করতেন। আল-কালকাশান্দী, সুবহুল আ’শা ৩/৪৯৮-৪৯৯
আহমদ ইবন আলী আল-মাকরীযী (৮৪৫ হিজরী) বলেন, এ সকল জন্মদিনের উৎসব ছিল তাদের খুবই বড় ও মর্যাদাপূর্ণ উৎসব। এ সময়ে মানুষেরা সোনা ও রুপার স্মারক তৈরি করতো, মিষ্টান্ন ও বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে বিতরন করতো। আল-মাকরীযী, আল-মাওয়ায়িজ ওয়াল ইতিবার, পৃষ্ঠা নঃ ৪৯১
এরপর সুন্নীদের মাঝে যেভাবে মিলাদুন্নবীর প্রচলন ঘটেঃ
শি’আদের দ্বারা প্রচলিত এই মীলাদুন্নবী মিশরের কায়রো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। শি’আদের এই অনুষ্ঠান সুন্নীদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। সুন্নীদের মাঝে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তক ছিলেন ইরাকের ‘ইরবিল’ প্রদেশের গভর্নর আবু সাঈদ কুকুবুরী (৬৩০ হিজরী)। আস-সালেহী, সীরাত শামিয়্যাহ ১/৩৬২
কুকুবুরী অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। ইমাম যাহাবী বলেন, তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি ধার্মিক, সবচেয়ে বেশি দানশীল, সমাজকল্যাণব্রত ও মানবসেবী বাদশাহদের অন্যতম। প্রতি বছর মীলাদুন্নবী উদযাপনের জন্য তিনি যে পরিমান অর্থ ব্যয় করতেন, তা সবার মুখে প্রবাদের মতো উচ্চারিত হতো। যাহাবী, নুবালা ৩/২০৮
ঐতিহাসিকদের মতে কুকুবুরী তার শাসনামল ৫৮৩ হিজরী থেকে ৬৩০ হিজরীর মধ্যে সর্বপ্রথম সম্ভবত ৬০৪ হিজরীতে (মতান্তরে ৬২৫ হিজরী) এই মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে এটা সুন্নীদের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বাগদাদ, মাউসিল, জাযিরা, সিনজার, নিসিসবিন ও পারস্যের বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেক আলেম, ক্কারী, সুফী, বক্তা, ওয়ায়েজ ও কবি কুকুবুরীর এই মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে জমায়েত হতে থাকেন।
খোলা প্রান্তরে ২০টি বা তারও বেশি বিশাল বিশাল কাঠের প্যান্ডেল তৈরি করা হতো। সেখানে থাকতো গায়কদল, অভিনয়কারীদের দল এবং বিভিন্ন খেলাধুলা দেখানোর দল। এ সময় সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যেত। সকলের একমাত্র কাজ হয়ে যেত এ সকল প্যান্ড্যালে ঘুরে বেড়ানো ও আনন্দ উল্লাস করা।
কুকুবুরী মীলাদুন্নবীর ২দিন আগেই অগনিত উট, গরু, ছাগল, ভেড়া মাঠে পাঠিয়ে দিতেন। তবলা বাজিয়ে, গান গেয়ে, আনন্দ উচ্ছাসের মধ্য দিয়ে এই সকল প্রাণীকে মাঠে পৌঁছানো হতো। সেখানেই সেগুলোকে জবাই করে রান্নার আয়োজন করা হতো। মীলাদুন্নবীর রাতে মাগরিবের নামাজের পর সামা গান-বাজনার আয়োজন করা হতো। পুরো এলাকাতে মোমবাতি প্রজ্জলন করে আলোকসজ্জা করা হতো। কুকুবুরী প্রতিটি প্যান্ড্যালে গিয়ে তাদের গান শুনতেন, খেলা ও অভিনয় দেখতেন। পরে সুফীদের খানকায় রাত কাটাতেন এবং সামা গান শুনে সুফীদের সাথে নাচতেন।
কুকুবুরীর মিলাদুন্নবী উপলক্ষে আয়োজিত দাওয়াতে তার দস্তরখানে থাকতো, প্রায় পাঁচশত আস্ত দুম্বার ভুনা, দশ হাজার মুরগী, লক্ষাধিক খাবারের পাত্র, ত্রিশ হাজার মিষ্টির খাঞ্চা। তার দাওয়াতে উপস্থিত হতেন সমাজের গণ্যমান্য আলেমগন, সুফীগন ও সাধারন মানুষজন। উপস্থিত সবাইকে কুকুবুরী মুক্তহস্তে হাদীয়া ও উপঢৌকন প্রদান করতেন। আর এভাবেই জমজমাট ও জৌলুসপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে শি’আদের দ্বারা প্রচলিত মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান খুব দ্রুত সুন্নী মহলে সমাদৃত হয় ও বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
কুকুবুরীকে সহায়তা করেন স্পেনের আবুল খাত্তাব উমার ইবনুল হাসান ইবনু দেহইয়াহ নামক এক দরবারী আলেম। তিনি মীলাদুন্নবীর সমর্থনে একটি কিতাব লিখেন ‘কিতাবুত তানভীর ফি মাওলিদিস সিরাজিল মুনীর’। এ বইটিতে তিনি অনেক জাল ও বানোয়াট হাদীস জমা করে করে কুকুবুরীর নিকট পেশ করেন। কুকুবুরী খুশি হয়ে তাকে সঙ্গে সঙ্গে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা বখশিশ দেন। তারিখ ইবন খাল্লিকান, ওয়াফাইতুল আ’য়ান ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা নঃ ১২২
যদিও তৎকালীন সময়ে কিছু আলেম এর বিরোধিতা করেছিলেন, তারপরও সাধারন মুসলমানদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পরে।
ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শি’আরাই এই মিলাদুন্নবী আমদানি করেঃ
ভারতের মোঘল সম্রাটদের কিছু মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা ছিল শি’আ। মোঘল সম্রাট হুমায়ুন ও সম্রাট আকবরের মা ছিল শি’আ। আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ কট্টর শি’আ ছিলেন। তারাই উপমহাদেশে সুন্নীদের মাঝে মিলাদুন্নবীর প্রচলন ঘটায়। মিলাদুন্নবী, আইনুল বারী আলিয়াভি, পৃষ্ঠা নঃ ৩৩
যে তারিখকে কেন্দ্র করে মিলাদুন্নবী পালন করা হয় তার ভিত্তি কতটুকু সঠিক?
রাসুল (সাঃ) যে বছরে জন্মগ্রহন করেছেনঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের সাল সম্পর্কে কায়স ইবন মাখরামা (রাঃ) হতে একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে যেঃ ‘’আমি ও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দু’জনই ‘হাতির বছরে’ জন্মগ্রহন করেছি’’ তিরমিযি ৩৬১৯ (আলবানি দুর্বল বলেছেন)
‘হাতির বছর’ বলা হয়, যে বছরে আবরাহা তার হস্তি বাহিনী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য মক্কা আক্রমন করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এ বছর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ ছিল। গ্রহণযোগ্য বর্ণনা মতে, এই বছরেই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) জন্মগ্রহন করেছেন। আকরাম জিয়া আর উমারী, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ আস-সাহীহাহ ১/৯৬-৯৮; মাহদী রেজাকুল্লাহ আহমাদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ, পৃষ্ঠা নঃ ১০৯-১১০; সীরাত ইবন হিশাম, পৃষ্ঠা নঃ ৩৮; সফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা নঃ ৭৬; আসাদুল্লাহ আল-গালীব, সীরাতুর রাসুল, পৃষ্ঠা নঃ ৫৪-৫৫; আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান পৃষ্ঠা নঃ ৫১৯
রাসুল (সাঃ) যেদিন জন্মগ্রহন করেছেনঃ
আবু কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে সোমবার দিন সিয়াম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে হলে, তিনি বলেনঃ ‘’এই দিনে আমি জন্মগ্রহন করেছি এবং এই দিনেই আমি নবুয়ত পেয়েছি’’ মুসলিম ১৯৭৮-(১৯৮/০০০)
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সোমবার নবুয়ত লাভ করেন, সোমবারে ইন্তেকাল করেন, সোমবারে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনার পথে রওয়ানা হন, সোমবারে মদীনা পৌঁছান এবং সোমবারেই তিনি হাজরে আসওয়াদ উত্তোলন করেন’’ মুসনাদ আহমাদ ৪/১৭২-১৭৩ নঃ ২৫০৬
মাহমুদ পাশা, যিনি কনস্টান্টিনোপলের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ তিনি তার যুগ থেকে ক্যালেন্ডার ঘেঁটে প্রমান করেছেন যে, সোমবার দিনটি ১২ই রবিউল আউয়াল ছিল না, বরং তা ৯ই রবিউল আউয়াল ছিল। আর ১২ই রবিউল আউয়াল ছিল বৃহস্পতিবার। এজন্য সঠিক বর্ণনা ও জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী ৯ই রবিউল আউয়ালকে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়। কাসাসুল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা নঃ ২৫৩-২৫৪
কোন মাসের কোন তারিখে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জন্মগ্রহন করেছেনঃ
রাসুলুল্ললাহ (সাঃ)-এর সহীহ হাদীসে তাঁর জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে ওয়াহী ভিত্তিক সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাহাবীগনের মাঝেও এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না। এ কারনে পরবর্তী যুগের আলেম ও ঐতিহাসিকগণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মতারিখ সম্পর্কে মতভেদ করেছেন।
ইবন হিশাম, ইবন সা’দ, ইবন কাসীর, কাসতালানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক ও সীরাতুন্নবী লেখকগন নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন।রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মতারিখ সম্পর্কে আলেমদের ১২টি মতামতঃ
১) কারো মতে তাঁর জন্মতারিখ অজ্ঞাত। তিনি সোমবারে জন্মগ্রহন করেছেন, শুধু এটুকুই জানা যায়। তাঁর জন্মমাস বা জন্মতারিখ সম্পর্কে জানা যায় না। এ বিষয়ে আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।
২) কারো কারো মতে, তিনি মুহারররাম মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
৩) কারো মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
৪) কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।
৫) কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।
৬) কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ১০ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।
৭) কারো মতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।
নোটঃ এ মতটি ইবন ইসহাক সনদ বিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। কোথা হতে তিনি এই তথ্যটি সংগ্রহ করেছেন, তাও তিনি জানাননি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দীর কোনো সাহাবী বা তাবেয়ী থেকে মতটি বর্ণনা করেননি। এজন্য অনেক গবেষক এই মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় এই দুর্বল মতটিই পরবর্তীতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
৮) কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।
৯) কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ২২ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।
১০) কারো মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
১১) কারো মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
১২) কারো মতে তিনি রমাদান মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
দ্রষ্টব্যঃ ইবন সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/১০০-১০১; ইবন কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২১৫; আল-কাসতালানী, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ, আল- মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ১/৭৪-৭৫; আল-যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ১/২৪৫-২৪৮; ইবন রাজাব, লাতায়েফুল মায়ারেফ ১/১৫০
পরবর্তীতে মিলাদুন্নবীকে সকল ঈদের সেরা ঈদ বলে ঘোষণা করা হয়। অথচ মুসলিমদের বাৎসরিক ঈদ মাত্র দু’টি- একটি ঈদুল ফিতর অপরটি ঈদুল আযহাঃ
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’প্রত্যেক জাতির জন্যই আনন্দোৎসব রয়েছে। আর এটা (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) হল আমাদের আনন্দের দিন’’ বুখারী ৯৪৯, ৯৫২, ৯৮৭, ৩৯৩১; মুসলিম ১৪৭৯-(ক)-(১৬/৮৯২), ১৪৮০-(১৭/…)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ) মদীনায় আগমন করার পর দেখেন, মদীনাবাসীরা নির্দিষ্ট দুটি দিনে খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদ করে থাকে। নবী (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি কিসের দিন? তারা বলল, ইসলামের পূর্বে জাহেলিয়াতের সময় এ দিন দুটিতে আমরা খেলাধুলা করতাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এ দু দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য আরও উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। এর একটি হল ঈদুল আযহার দিন অপরটি ঈদুল ফিতরের দিন’’ নাসায়ী ১৫৫৬; আবু দাউদ ১১৩৪; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৪৩৯ (আলবানি সহীহ বলেছেন)
এছাড়া জুম’আর দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন হিসাবে অভিহিত করা হয়েছেঃ
ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এ দিনকে ঈদের দিন হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি জুম’আর সলাত আদায় করতে আসবে, সে যেন গোসল করে এবং সুগন্ধি থাকলে তা শরীরে লাগায়। আর মেসওয়াক করাও তোমাদের কর্তব্য’’ ইবন মাযাহ ১০৯৮; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৩৯৯ (আলবানি হাসান বলেছেন)
উবায়েদ ইবন সাব্বাক (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোনো এক জুম’আর দিন বলেছেনঃ ‘’হে মুসলিমগণ! এ দিন, যে দিনকে আল্লাহ তায়ালা ঈদ হিসাবে গণ্য করেছেন। অতএব তোমরা এ দিন গোসল করবে। যার কাছে সুগন্ধি আছে, সে তা ব্যাবহার করলে কোনো ক্ষতি নেই। তোমরা অবশ্য অবশ্যই মেসওয়াক করবে’’ মিশকাতুল মাসাবীহ ১৩৯৮ (আলবানি হাসান বলেছেন)
বাৎসরিক ঈদ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এবং সাপ্তাহিক ঈদ জুম’আ ছাড়া অন্য কোনো দিনকে ঈদের দিন হিসাবে পালন করা অথবা বিশেষ কোনো আমল করা নিঃসন্দেহে ভ্রষ্টতা। কারন এরুপ নির্দেশনা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) থেকে প্রমানিত নয়। রাসুল (সাঃ) নবুওতের ২৩ বছরে কখনোই নিজের জন্মদিন পালন করেননি। কোনো সাহাবী পালন করেছেন বলেও প্রমানিত নয়। এমনকি চারজন খলীফাও রাষ্ট্রীয়ভাবে অথবা একাকী এই দিবস পালন করেননি। চার ইমাম থেকেও এর কোনো প্রমান নেই। সুতরাং ১২ রবিউল আউয়াল নবী (সাঃ)-এর জন্মদিন পালন করা ও এই উপলক্ষে কোনরূপ ইবাদত করা শরীয়ত সম্মত নয়, বরং নিঃসন্দেহে বিদ’আত।
সুতরাং ১২ই রবিউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে ও এই দিনকে ঈদে মিলাদুন্নবী ঘোষণা করে জামা’আতবদ্ধ হয়ে অথবা একাকী, মসজিদে অথবা বাড়িতে বিশেষ কোনো নফল ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং এরুপ করা নিঃসন্দেহে বিদ’আতের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
বিদ’আতি আমল আল্লাহর নিকট কবুল হবে না এবং বিদ’আতের পরিনাম জাহান্নামঃ
নবী (সাঃ)-এর অনুসরন বাদ দিয়ে মনগড়াভাবে অথবা নিজস্ব খেয়াল-খুশি মতো ইবাদতের সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলামে ইবাদত হচ্ছে ‘তাওকিফী’। অর্থাৎ কোনো কিছুকে ইবাদত হিসাবে সাব্যস্ত করতে হলে তার জন্য দলীল লাগবে। দলীল বিহীন কোনো কাজকে ইবাদত বলার কোনো সুযোগ নেই।
বিদ’আতের পরিনতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কটি দেখতে পারেনঃ https://bit.ly/2PuADYt
ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত দু’টিঃ
১-ইখলাসঃ দলীলঃ ”তাদেরকে এ ছাড়া আর অন্য কোন হুকুমই দেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে’’ বাইয়েনাহ ৯৮/৫
২-রাসুল (সাঃ)-এর অনুসরনঃ আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সঃ) বলেছেনঃ ‘’যে ব্যাক্তি আমার এই দ্বীনে (নিজের পক্ষ থেকে) কোন নতুন কথা উদ্ভাবন করল, তা প্রত্যাখ্যাত’’ বুখারী ২৬৯৭; মুসলিম ৪৩৮৪-(১৭/১৭১৮), ৪৩৮৫-(১৮/…); ইবন মাযাহ ১৪; আবু দাউদ ৪৬০৬; রিয়াদুস স্বালিহিন ১৭৩
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘’নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম রীতি মুহাম্মাদ (সঃ)- এর রীতি। আর নিকৃষ্টতম কাজ (দ্বীনে) নব আবিষ্কৃত কর্মসমূহ এবং প্রত্যেক বিদ’আত ভ্রষ্টতা’’ মুসলিম ১৪৩৫(ক)-(৪৩/৮৬৭); ইবন মাযাহ ৪৫ নাসায়ীর বর্ণনায়, ‘সকল বিদ’আতের পরিণতি জাহান্নাম’ নাসায়ী ১৫৭৮
আবু নাজীহ ইরবায ইবন সারিয়াহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ”স্মরণ রাখ! তোমাদের মধ্যে যে আমার পর জীবিত থাকবে, সে অনেক মতভেদ বা অনৈক্য দেখবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের রীতিকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাত দিয়ে মজবুত করে ধরে থাকবে। আর তোমরা দ্বীনে নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ (বিদ’আত) থেকে বেঁচে থাকবে। কারন প্রত্যেক বিদ’আতই ভ্রষ্টতা’’ আবু দাউদ ৪৬০৭; রিয়াদুস সালিহীন ১৬১ (আলবানি সহীহ বলেছেন)
সুতরাং আমল করলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্যেশে ও রাসুল (সাঃ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী হবেঃ
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’বল- আমি তোমাদেরকে কি সংবাদ দেবো নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে কারা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত? তারা হল সেই সব লোক দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা সাধনা ব্যর্থ হয়ে গেছে, আর তারা নিজেরা মনে করছে যে, তারা সঠিক পথেই আছে’’ কাহাফ ১৮/১০৩-১০৪
মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেনঃ ‘’কতক মুখ সেদিন নিচু হবে। আমল করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে তারা জলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে’’ গাশিয়াহ ৮৮/২-৩
নেকি লাভের সকল কর্ম রাসুল (সাঃ) শিক্ষা দিয়েছেন, নতুনত্বের কোনই অবকাশ নেই। উম্মাতকে আল্লাহর নৈকট্যের সকল পথ বলে দেয়া রাসুল (সাঃ)-এর দায়িত্ব এবং তিনি তা যথাযথভাবে পালন করেছেন। তাঁর সুন্নাতের বাইরে গিয়ে আল্লাহর নৈকট্য বা সাওয়াব অর্জনের কোন পথ নেইঃ
আব্দুর রহমান আব্দ রাব্বিল কা’বা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ ‘’আমার পূর্বে প্রত্যেক নাবীরই দায়িত্ব ছিল যে, তিনি তাঁর উম্মাতের জন্য যত ভালো বিষয় জানেন সে বিষয়ে তাদেরকে নির্দেশনা দান করবেন। এবং তিনি তাদের জন্য যত খারাপ বিষয়ের কথা জানেন সেগুলি থেকে তাদেরকে সাবধান করবেন’’ মুসলিম ৪৬৭০-(৪৬/১৮৪৪)
রাসুল (সাঃ) আরও বলেনঃ ‘’জান্নাতের নিয়ে যাওয়ার ও জাহান্নাম থেকে দূরে থাকার সকল বিষয়ই তোমাদেরকে বর্ণনা করে দেয়া হল’’ তাবারানী, আল-মুজাম আল-কাবীর ২/১৫৫-১৫৬, নঃ ১৬৪৭
ইসলাম সমর্থিত রীতি ছাড়া অন্য পথে আমলের পরিনতিঃ
আল হারিস আল-আশ’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ ”আর যে লোক জাহেলিয়াতের আমলের রীতিনীতির দিকে আহবান করে, সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত। জনৈক ব্যাক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! সে নামাজ আদায় করলেও রোজা রাখলেও? তিনি বললেনঃ হাঁ, সে নামাজ-রোজা করলেও” তিরমিযি ২৮৬৩ (আলবানি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
বিজাতীয় ও অমুসলিমদের অনুষ্ঠান বর্জন করা এবং ইসলামের দেয়া বিধান ও উৎসবই একজন মুসলিমের জন্য পালনীয়। এবং এতেই একজন মুসলিম কল্যাণ লাভ করতে পারে। নতুবা যারা অমুসলিমদের উদ্ভাবিত রীতিনীতি ও তাদের আনন্দ উৎসবে উল্লাসিত হবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হিসাবে গণ্য হবে। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ ”যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই দলভুক্ত গণ্য হবে” আবু দাউদ ৪০৩১ (আলবানি হাসান বলেছেন)
মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর মাধ্যমে যা কিছু এসেছে তাতেই আনন্দ লাভ করা একজন মুমিনের কর্তব্য। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’বল- আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার বদৌলতে (যা এসেছে), এজন্য তারা আনন্দিত হোক’’ ইসরা ১০/৫৮
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিদা’আত মুক্ত হয়ে সুন্নাহ সম্মত ইবাদত পালনের তৌফিক দান করুন।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১) আর-রাহীকুল মাখতুম, সফিউর রহমান মোবারকপুরী।
২) সীরাতে ইবন হিশাম।
৩) সীরাতুর রাসুল, আসাদুল্লাহ আল-গালীব।
৪) ফাতাওয়া আরাকানুল ইসলাম, সালিহ আল উসাইমিন।
৫) যাদুল মা’আদ- ইবনুল কাইয়িম।
৬) বিদ’আত হতে সাবধান, আব্দুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায।
৭) বিদ’আতের ভয়াবহতা, সালিহ আল উসাইমিন।
৮) বিদ’আত থেকে সাবধান, সালিহ আল ফাওযান।
৯) এহইয়াউস সুনান, আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর।
১০) মীলাদ প্রসঙ্গ, আসাদুল্লাহ আল-গালীব।
১১) নবীদের কাহিনী, আসাদুল্লাহ আল-গালীব।
১২) ঈদে মিলাদুন্নবী, মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী।
১৩) বার মাসে তের পরব, আব্দুল হামীদ ফাইযী।
১৪) মিলাদুন্নবী, হাবীবুল্লাহ খান রহমানী।
১৫) মীলাদ জায়িয ও নাজায়িযের সীমারেখা, হুসাইন বিন সোহরাব।
১৬) মৌলুদ শরীফ, আবু তাহের বর্ধমানী।
১৭) মীলাদ, শবে বরাত মীলাদুন্নবী কেন বিদ’আত, হাফেয মুহাম্মাদ আইয়ুব।
১৮) খুতবাতুল ইসলাম, ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর।