23:6 আল মুমিনুন
إِلَّا عَلٰىٓ أَزْوٰجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمٰنُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ
তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া, নিশ্চয় এতে তারা নিন্দিত হবে না।
নিজেদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসী ব্যতীত, কারণ এ ক্ষেত্রে তারা নিন্দা থেকে মুক্ত।
১-১১ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে মু’মিনদের ছয়টি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। যারা এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারবে তাদের ফলাফল ১০-১১ নং আয়াতে উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তারাই হল জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। জান্নাতুল ফিরদাউস অন্যান্য জান্নাত থেকে উত্তম ও আরশের নিচে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন তোমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে জান্নাত চাইবে তখন জান্নাতুল ফিরদাউস চাইবে, কারণ তা সর্বোত্তম ও সবার ঊর্ধ্বে। তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার আরশ, সেখান থেকেই জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হয়। (সহীহ বুখারী হা: ২৭৯০)
قَدْ শব্দটি অতীত কালের ক্রিয়ার পূর্বে ব্যবহার হলে অবশ্যই ও নিশ্চয়তার অর্থে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ অবশ্যই মু’মিনরা সফলকাম হয়ে গেছে। এখনো মু’মিনরা জান্নাতে যায়নি অথচ তারপরেও নিশ্চয়তা দেয়া হল কিভাবে? অর্থাৎ মু’মিনরা জান্নাতে যাবে এবং সফলকাম হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আয়াতে উল্লিখিত ছয়টি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য হল:
(فِيْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ)
‘সালাতে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে’ خشوع অর্থ আন্তরিক ও বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা। অন্তরের একাগ্রতা হল সালাতরত অবস্থায় ইচ্ছাকৃত খেয়াল, কল্পনা ও যাবতীয় চিন্তা থেকে অন্তরকে মুক্ত রেখে আল্লাহ তা‘আলার সামনে উপস্থিত রাখা। আর বাহ্যিক একাগ্রতা হল শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া না করা। বরং ভয়-ভীতি, কাকুতি-মিনতি ও বিনয়ের সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে সামনে উপস্থিত মনে করে সালাত আদায় করা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়াবে তখন যেন সামনে থুথু না ফেলে, কেননা যতক্ষণ সে সালাতে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহ তা‘আলার সাথে গোপনে কথা বলে। ডান দিকেও ফেলবে না, কারণ ফেরেশতারা ডান দিকে থাকে। যদি থুথু ফেলতে হয় তাহলে বাম দিকে ফেলবে বা পায়ের নিচে ফেলবে। (সহীহ বুখারী হা: ৪১৬)
শানে নুযূল:
ইবনু আবী হাতিম হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন সালাতে দাঁড়াতেন তখন তিনি ডানে-বামে এদিক-সেদিক তাকাতেন, তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অতঃপর তিনি তাঁর মাথাকে নত করে নিলেন। (আবূ দাঊদ তার ‘মারামিল’ নামক গ্রন্থে, হা: ৯৬)
আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) থেকে অন্য আরেকটি বর্ণনা আছে যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন সালাত পড়তেন তখন তিনি তাঁর দৃষ্টিকে আকাশের দিকে ফিরাতেন। এরপর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তখন তিনি তাঁর মাথাকে নত করে নেন। (হাকিম ২:৩৯৩, মুরসাল সহীহ)
সুতরাং একজন মু’মিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অবশ্যই আদায় করবে, সেই সাথে সালাত বিনয়-নম্রতার সাথে আদায় করবে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
(عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ)
‘অসার ক্রিয়াকলাপ হতে বিরত থাকে’ اللَّغْوِ বলা হয় এমন সব কথা ও কাজকে যাতে কোন কল্যাণ ও উপকারিতা নেই। সফলকাম মু’মিনরা এরূপ কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوْا عَنْهُ)
“তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন তারা তা উপেক্ষা করে চলে।” (সূরা কাসাস ২৮:৫৫) সূরা ফুরকানের আয়াতে বলা হয়েছে মু’মিনরা এরূপ অনর্থক ও বেহুদা কোন কিছুর সম্মুখীন হলে ভদ্রভাবে চলে যায়, তাতে জড়িত হয় না এবং কোন বিবাদে লিপ্ত হয় না। সুতরাং যদি অসার ও অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা প্রশংসনীয় কাজ হয় তাহলে হারাম কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা কত বেশি প্রশংসনীয় হবে তা সহজেই অনুমেয়।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:
(لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْنَ)
‘যাকাতদানে সক্রিয়’ এখানে যাকাত বলতে বিদ্বানগণ দুটি দিক বর্ণনা করেছেন: (১) যাকাত দ্বারা উদ্দেশ্য হল সম্পদের যাকাত, এটাই অধিকাংশদের মত যা ইবনু কাসীর বর্ণনা করেছেন। (২) নাফসের যাকাতন নাফসের যাকাত হল শিরকী, বিদ‘আতী বিশ্বাস থেকে মুক্ত রাখা, নিজেকে পাপ কাজে জড়িত না করা। সর্বদা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করা। এ অর্থে কুরাআনে এসেছে:
(قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكّٰهَا – وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰهَا)
“যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ হয়।” (সূরা শামস ৯১:৯-১০) (আযওয়াউল বায়ান)
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:
(لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَ)
‘যৌনাঙ্গকে হেফাযতে রাখে’ নিজ স্ত্রী বা অধিকারভুক্ত দাসী ছাড়া অন্য যে কোন পন্থায় নিজে যৌন চাহিদা নিবারণ করা যৌনাঙ্গের হেফাযত নষ্ট করা। তা কোন অবৈধ মহিলার সাথে হতে পারে, কোন অপরিচিত গার্ল ফ্রেন্ড হতে পারে বা কোন পুরুষের সাথে সমকামিতার মাধ্যমে হতে পারে বা অন্য যে কোন উপায়ে হতে পারে। যে কেউ নিজ স্ত্রী ও দাসী ছাড়া অন্য কোন উপায়ে যৌন চাহিদা নিবারণ করবে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَ- إِلَّا عَلٰٓي أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُوْمِيْنَ)
“এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে, তাদের স্ত্রী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যতীত, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না।” (সূরা মাআরিজ ৭১:২৯-৩০) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا يَزْنُوْنَ ط ج وَمَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ يَلْقَ أَثَامًا)
“আর ব্যভিচার করে না। যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৮) অতএব বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত, একজন মু’মিন যে আখিরাতের সফলতা কামনা করে সে কখনো এমন কাজে জড়িত হতে পারে না।
পঞ্চম বৈশিষ্ট্য:
(لِأَمٰنٰتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رٰعُوْنَ)
‘আমানত ও প্রতিশ্র“তি রক্ষা করে’ আমানত ও প্রতিশ্র“তি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাংশ মানুষের এ ক্ষেত্রে পদস্খলন ঘটে। আমানতের গুরুত্ব নিয়ে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
أَدِّ الْأَمَانَةَ إِلَي مَنِ ائْتَمَنَكَ، وَلَا تَخُنْ مَنْ خَانَكَ
তুমি আমানত আদায় করে দাও যে তোমার কাছে আমানত রেখেছে, যে খিয়ানত করেছে তার সাথে খিয়ানত করো না। (তিরমিযী হা: ১২৬৪, সহীহ) প্রতিশ্র“তি পালন করার গুরুত্বও অপরসীম। এমনকি তা ভঙ্গ করা মুনাফিকদের আলামত বলা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩, সহীহ মুসলিম হা: ৫৯) আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র আরো বলেন:
(وَأَوْفُوْا بِالْعَهْدِ ج إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُوْلًا)
“প্রতিশ্র“তি পালন কর; নিশ্চয়ই প্রতিশ্র“তি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৩৪)
ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য:
(عَلٰي صَلَوٰتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ)
‘সলাতে যত্নবান থাকে’ অর্থাৎ সর্বদা সালাতের রুকন-আরকান, শর্ত ও উত্তম ওয়াক্তে সালাত আদায় করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলা হলো কোন্ আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন: সময়মত সালাত আদায় করা। অন্য বর্ণনায় এসেছেন প্রথম ওয়াক্তে। (সহীহ বুখারী হা: ৭৫৩৪, তিরমিযী হা: ১৭০) এখানে দ্বিতীয় বার সালাতের কথা নিয়ে আসা হয়েছে যাতে করে মানুষ সিালাতকে গুরুত্ব দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(حَافِظُوْا عَلَي الصَّلَوَاتِ وَالصَّلٰوةِ الْوُسْطٰي ق وَقُوْمُوْا لِلّٰهِ قٰنِتِيْنَ)
“তোমরা সালাতসমূহের প্রতি যতœবান হও। বিশেষ করে (যতœবান হও) মধ্যম সালাতের প্রতি। আর আল্লাহ তা‘আলার সামনে বিনীতভাবে দাঁড়াও।” (সূরা বাকারাহ ২:২৩৮)
অতএব প্রতিটি ব্যক্তি যারা নিজেদেরকে ঈমানদার বলে দাবী করে এবং আখিরাতে সফলতা কামনা করে তাদের উচিত হবে যে, এ সকল বৈশিষ্ট্যাবলী তাদের জীবনে গ্রহণ করবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সালাত বিনয় ও নম্রভাবে যত্নসহকারে আদায় করতে হবে।
২. মু’মিন কখনো নিজ স্ত্রী বা দাসী ব্যতীত অন্য কারো সাথে জৈবিক চাহিদা পূরণ করে না।
৩. সম্পদের যথাযথ হক্ব (যাকাত) আদায় করতে হবে।
৪. ওয়াদা ভঙ্গ করা যাবে না এবং আমানত ঠিক রাখতে হবে।
৫. যে সকল মু’মিন ব্যক্তি উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্জন করতে পারবে তারাই জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকারী হবে।
Filed under: Uncategorized | Leave a comment »